আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া নানা কারণে বিখ্যাত। মুঘল আমলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মসলিন কাপড় তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল। এ জেলার বিখ্যাত মিষ্টান্নের মধ্যে ছানামুখী অন্যতম, যা দেশের অন্য কোন অঞ্চলে তেমন প্রচলন নেই। এছাড়া তালের রস দিয়ে তৈরি আরেকটি মিষ্টান্ন তালের বড়া ও রসমালাই বিখ্যাত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুতুলনাচ ও তিতাস নদীর নৌকা বাইচের জন্যেও বিখ্যাত।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাটি ১৯৮৪ সালে আত্মপ্রকাশ করে এবং পূর্বে এটি কুমিল্লা জেলার একটি মহকুমা ছিল। এ জেলাটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত। এ জেলার পশ্চিমে নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও কিশোরগঞ্জ জেলা, পূর্বে হবিগঞ্জ ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য অবস্থিত, দক্ষিণে কুমিল্লা জেলা এবং উত্তরে অবস্থিত কিশোরগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলা। ১৯২৭.১১ বর্গ কিমি নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাটি বিস্তৃত। এ জেলাটি ৯টি উপজেলা ও ৯টি থানা নিয়ে গঠিত।
মুঘল আমলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মসলিন কাপড় তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল। এ জেলার বিখ্যাত মিষ্টান্নের মধ্যে ছানামুখী অন্যতম, যা দেশের অন্য কোন অঞ্চলে তেমন প্রচলন নেই। এছাড়া তালের রস দিয়ে তৈরি আরেকটি মিষ্টান্ন তালের বড়া ও রসমালাই বিখ্যাত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুতুলনাচ ও তিতাস নদীর নৌকা বাইচের জন্যেও বিখ্যাত।

মসলিন কাপড়:
ঢাকার ইতিহাস চারশো বছরের বেশি পুরনো নয়। ১৬১০ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় ইসলাম খান চিশতী রাজমহল থেকে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করলে ঢাকা ইতিহাসের প্রসিদ্ধতা লাভ করে। কিন্তু ঢাকার ইতিহাস বেশি পুরনো না হলেও মসলিনের ইতিহাস অনেকটাই পুরনো ও দীর্ঘ। স্মরণাতীত বাংলায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথম খ্রিস্টাব্দের প্রথম শতকেই রোম সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে অভিজাত রোমান নারীরা ঢাকার মসলিন পরে দেহসৌষ্ঠব প্রদর্শন করতে ভালোবাসতেন।
একই শতকে রচিত ‘পেরিপ্লাস অব দ্য এরিথ্রিয়ান সি’ শীর্ষক গ্রন্থে মসলিন সম্পর্কে বিশেষ ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। ” এতে মোটা ধরনের মসলিনকে মলোচিনা, প্রশস্ত ও মসৃণ মসলিনকে মোনাচি এবং সর্বোৎকৃষ্ট মসলিনকে গেনজেটিক বা গঙ্গাজলী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।” নবম শতকে রচিত আরব ভৌগোলিক সোলাইমানের ‘সিলসিলাত উত তাওয়ারীখে ‘রুমি’ নামক একটি রাজ্যের বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানে এমন সূক্ষ্ম ও মিহি সুতি বস্ত্র পাওয়া যেত যে, ৪০ হাত লম্বা ও ২ হাত চাওড়া।
এক টুকরো কাপড় আংটির ভিতর দিয়ে অনায়াসে নাড়াচড়া করা যেতো। তৎকালীন এই বস্ত্র তিনি সেখানে ব্যতীত আর কোথাও দেখেন নি। আর এই রুমি রাজ্যকে বাংলাদেশের সাথে অভিন্ন ধরা হয়। চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলায় আগত মরক্কো দেশিয় পর্যটক ইবনে বতুতা তার কিতাবুর রেহালায়’ সোনারগাঁওয়ে তৈরি সুতি বস্ত্রের বিশেষ প্রশংসা করেন।

পঞ্চদশ শতকে বাংলাদেশে আসা চীনা লেখকরা ও এখানকার সুতি বস্ত্রের ভুয়সী প্রশংসা করেন। মোগল সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল ফজল’ পর্যন্ত সোনারগাঁওয়ে প্রস্তুতকৃত এই সূক্ষ্ম সুতি বস্ত্রের প্রশংসা করতে ভুলেন নি। এভাবে সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে ঢাকাকে বাংলার রাজধানী ঘোষণার পর হতেই ইউরোপিয় ব্যবসায়ীরা বাংলায় আসা শুরু করেন।
এসকল বণিক কোম্পানি গুলোর তৎকালীন দলিল-দস্তাবেজ এবং ঐ সমকালীন ইউরোপীয় লেখকদের বিবরণে মসলিন সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। অবশেষে, ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে ইংরেজরা ক্ষমতাকে তাদের হাতে কুক্ষিগত করে ফেললে আস্তে আস্তে মসলিন বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করে এবং একটা সময় মসলিন হারিয়ে যায়।
হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে, জেমস টেইলরের রচনা অবলম্বনে ইতিহাসবিদ আব্দুল করিম তার ‘ঢাকাই মসলিন’ গ্রন্থে উদ্বৃতি পেশ করেন। এছাড়াও তিনি উল্লেখ করেন যে, সমসাময়িক লেখকদের (যেমন, জেমস টেলর, বোল্ট, জন টেলর প্রমূখ) বিবরণের অভাবে প্রকৃতপক্ষে মোগল আমলে মসলিন কত সূক্ষ্ম ও মিহি ছিল তার কোন সঠিক ও অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় না।
ইংরেজ ইতিহাসবিদদের লেখাতে এ বিষয়ে কিছু মতামত পাওয়া গেলেও সেগুলো পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়। কারণ, তাদের কেউই মোগল আমলের স্বর্ণযুগ দেখেনি। এছাড়াও তাদের মাঝে পরষ্পর বিরোধী অসংখ্য মতানৈক্যের ছড়াছড়ি লক্ষ্যণীয়। তারা এমন সময় বাংলায় আসেন যখন বাংলায় মসলিন শিল্প বিলুপ্তির পথে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে।
একটি বিষয় চিন্তা করলে বুঝা যায় যে, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তৈরি অর্ধটুকরা একখানি মসলিন (১০গজ × ০১গজ) ১৮৫১ সালে বিলেতের প্রদর্শনীতে প্রদর্শন করা হয়েছিল। এর ওজন ছিলো আট তোলা।পাশাপাশি, ঢাকা জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত মসলিন খানির দৈর্ঘ্যও ১০ গজ এবং চওড়া ১ গজ, এর ওজন মাত্র ৭ তোলা। তাহলে ঢাকার মসলিন মোগল শিল্পের স্বর্ণযুগে যে, আরো সূক্ষ্মভাবে তৈরি করা যেতো সেটা সহজেই অনুমান করা যায়।

অন্যান্য দর্শনীয় স্থান যে কারণে বগুড়া বিখ্যাত:
আরিফাইল মসজিদ:
আরিফাইল মসজিদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলায় অবস্থিত ১৭ শতকের একটি মসজিদ। এটি মুঘল স্থাপত্যের একটি চমৎকার নিদর্শন এবং এটি জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়। মসজিদটি ইট ও চুন মর্টার দিয়ে তৈরি এবং একটি বড় কেন্দ্রীয় গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের অভ্যন্তরভাগ জটিল পুষ্পশোভিত এবং জ্যামিতিক নকশায় সজ্জিত।
হাতিরপুল ব্রিজ:
হাতিরপুল ব্রিজ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলায় অবস্থিত একটি প্রাচীন সেতু। এটি ১৭ শতকে মুঘল আমলে নির্মিত হয়েছিল এবং এটি জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হিসাবে বিবেচিত হয়। সেতুটি ইট-পাথর দিয়ে তৈরি এবং একটি একক খিলান রয়েছে। ধারণা করা হয়, হাতিদের বিশ্রামের জায়গা হিসেবে সেতুটি তৈরি করা হয়েছিল।
গোকর্ণ নবাব বাড়ি কমপ্লেক্স:
গোকর্ণ নবাব বাড়ি কমপ্লেক্স ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার গোকর্ণ উপজেলায় অবস্থিত একটি ১৭শ শতাব্দীর প্রাসাদ কমপ্লেক্স। এটি ঢাকার নবাবদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল এবং এটি জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়। কমপ্লেক্সটিতে একটি মসজিদ, একটি সমাধি এবং একটি প্রাসাদ সহ বেশ কয়েকটি ভবন রয়েছে। ভবনগুলি ইট এবং চুন মর্টার দিয়ে তৈরি এবং জটিল পুষ্পশোভিত এবং জ্যামিতিক নিদর্শন দ্বারা সজ্জিত করা হয়।
ধরোন্টি হাওর:
ধোরন্তি হাওর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় অবস্থিত একটি বৃহৎ স্বাদু পানির হ্রদ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং প্রচুর বন্যপ্রাণীর জন্য এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য। হ্রদটি বিভিন্ন ধরণের পাখি, মাছ এবং অন্যান্য প্রাণীর আবাসস্থল। এটি বোটিং এবং মাছ ধরার জন্য একটি জনপ্রিয় স্পট।
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য স্থানগুলির মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া দুর্গ, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং আখাউড়া স্থলবন্দর অন্তর্ভুক্ত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অনেক পর্যটন আকর্ষণের মধ্যে এগুলি কয়েকটি মাত্র। জেলার একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং সংস্কৃতি রয়েছে এবং এখানে অন্বেষণ করার অনেক জায়গা রয়েছে।
আরও পড়ুনঃ
১ thought on “ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত”